আয়নামহল (পর্ব-৩)

আয়নামহল (পর্ব-৩)
-সঞ্জয় গায়েন

 

 

১০
লোকলজ্জার মাথা খেয়ে
ছেলে হয়ে সাজলো মেয়ে

ঠাস করে চড় কষিয়েছিলাম। বড় হয়ে যাওয়ার পর মারধোর বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মা হয়ে সতেরো বছরের ছেলের গায়ে হাত তুলতে কি ভালো লাগে! কিন্তু ওই বাধ্য করেছিল। সবাই মিলে অত বোঝানোর পরও সবার অবাধ্য হয়ে মেয়ে সেজে কলেজ যাওয়া শুরু করেছিল। বাড়ির কথা কোনদিনই ভাবতো না। নাই ভাবুক। কিন্তু লোকলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে। সেই লোকলজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ে সেজে রাস্তায় বেরোতে একটুও বাঁধল না ওর। ও কেন বুঝলো না, অমন সেজে গেলে ওকে সবাই ‘হিজড়া’ বলে ডাকবে। ডাকতোও তো। আর সেই ডাক শোনার পর মায়ের বুক কিভাবে ফাটতো তা কেন ও বুঝতো না? জানি ও বারবার আমাকে বলত, মা, আমি তোমার ছেলে নই, আমি তোমার মেয়ে। ভগবান আমাকে ভুল শরীর দিয়েছে। ওর এই কথাগুলো কিছুটা হলেও সত্যি ছিল। নারীত্বের কিছু চিহ্ন ওর শরীরে দেখাও দিয়েছিল। সেই চিহ্নগুলোকে মুছে ফেলতে কম চেষ্টা তো করিনি। কিন্তু কিচ্ছু ফল হয় নি।
শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওকেও আর কিছু বলতাম না। চেয়েছিলাম, ও মুখ বুজে পড়াশোনাটা শেষ করুক। তারপর যা হোক একটা চাকরী বাকরী… এইসব বলে ওকে বোঝাতাম। বলতাম, দ্যাখ সবসময় অত শরীর শরীর না ভেবে আগে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাব। শুনে ও বলত, নিজের মনের মতো করে এখন বাঁচি, তারপর ভবিষ্যতের কথা ভাবব। ওর এই মুখের উপর কথা বলাটা আগে ছিল না। আগে চুপ করে সব সহ্য করে নিত। কিন্তু বড় হয়ে কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হত, ওকে কি কেউ এসব বলা শিখিয়ে দিচ্ছে। আর তার সাহসেই ও শালোয়ার কামিজ পরে কলেজ যেতে শুরু করেছিল। তাই চড় মারার পরেও ও মেয়ে সাজা ছাড়ে নি। আমি তখন বুঝেছিলাম, না, মারধোর ধরে কিচ্ছু হবে না। আগে জানতে হবে ও কলেজ যাওয়ার নাম করে অন্য কোথাও যায় কিনা। সেই জানার জন্য ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই ওর পিছু ধাওয়া করতাম। তাতেও কোন ফল হয় নি। ও সোজা কলেজেই যেত। তবু সন্দেহটা ছিলই। শুধু মনে হত, কলেজের ভিতরের কেউ বন্ধু সেজে ওর এই সর্বনাশ করছিল না তো? কিন্তু তা হলে তা আটকাবার উপায় কোথায়!
এরই মধ্যে ওর ঘর পরিষ্কার করতে একদিন এক প্যাকেট ওষুধ পেয়েছিলাম। বালিশের তলা থেকে। কিসের ওষুধ খেত ও! কেনই বা খেত! জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, ওসব জেনে তোমাদের কোন লাভ নেই। তোমরা তোমাদের মতো থাকো। আমি আমার পথ ঠিক পেয়ে যাব।
ওর মুখে এমন উত্তর শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। বছর তিনেক আগে যাকে নিজে হাত ধরে ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়েছি, সেই ছেলে তিন বছরে এত বড় হয়ে গেল যে নিজে নিজে ডাক্তার দেখাতে শিখে গিয়েছে! না, না, এ হতে পারে না। হাজার হোক মায়ের মন তো! ছেলে মিথ্যে বললে বা কিছু লুকোলে মা বুঝতে পারবে না তা কি হয়! আমি ঠিক বুঝেছিলাম, ও আমার কাছে নিজেকে গোপন করা শুরু করেছিল।
ছেলে হলে ওর গোপনীয়তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে এড়িয়ে যেতাম। মেয়ে হলে বেশি বেশি করে কাছে টেনে নিতাম। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে না পেরেছি এড়িতে যেতে, না পেরেছি কাছে টেনে নিতে। তাই বাধ্য হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখা শুরু করেছিলাম। আর সেটা দেখতে গিয়েই বুঝেছিলাম, ওর বুক যেন দিনদিন ভারী হচ্ছিল। তবে কি ওই ওষুধগুলো সেজন্যই খেত! হে ভগবান, মনের মতো শরীর পেতে গিয়ে ও কোন বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছিল? কিছুই তো বলতো না। তবু বুঝতাম, বিপদ আসবেই। বড় বিপদ!

১১
ক্লাসরুমে স্তনে হাত
নিত্য নতুন উৎপাত

পিসতুতো দাদা সেইসময় প্রায়ই আদর করতো। আমার শরীরটাকে। চটকাতো আর বলতো, তোকে দেখলেই কেমন মেয়ে মেয়ে মনে হয়। কী সুন্দর নরম, তুলতুলে তোর শরীর। তোর বুক দু’টোও বেশ, বলেই সেখানে মুখ গুঁজতো। নাক ঘষতো। তারপরেই বলেছিল, অ্যাই এই বুক দু’টোকে পুরো মেয়েদের মতো করতে পারিস তো। আমি বলেছিলাম, তা আবার হয় নাকি! খুব হয়। তুই করবি কিনা বল শুধু। যা খরচ লাগবে আমি দেব। দাদার মুখে এরকম লোভনীয় প্রস্তাব শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। আর দাদা সেই সুযোগে আমার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে ওর পুরুষাঙ্গ ঢুকিয়ে বলেছিল, তোর শরীরটাকে গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। কোন চিন্তা করিস না।
কথামতো দাদা একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধও খাওয়া শুরু করেছিলাম। কী আশ্চর্য্য ম্যাজিকের মতো ফল হচ্ছিল। ক’মাস যেতে না যেতেই আমার পাছা বুক সব ভারী হয়ে উঠছিল। তাই দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। এত সুখ এর আগে পাই নি। যেন উপছে পরছিল শরীর বেয়ে।
কিন্তু অন্যদের তা সহ্য হবে কেন। একে তো শুধুই শরীর! মনটার দাম কোনদিও কেউ দিত না। চাইও নি কারও কাছে। এমনকি যে দাদা এত্ত এত্ত খরচ করছিল আমার জন্য তার কাছেও না। দাদার কাছে যদি আমার মনের কোন দাম থাকতো, তাহলে দাদা আর সবার সামনে আমাকে না চেনার ভান করতো না। দাদা প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতো। এটা ওটা ছুঁতো নিয়ে। আমাকে অবশ্য ফোন করে বলে দিত কবে কখন আসবে। আর তা শুনে নিয়ে আমাকে কিছু একটা অজুহাত খুঁজে কলেজ ছুটি করে বাড়িতে থাকতে হত। কিন্তু দাদা এসেই আমার মায়ের সঙ্গে গল্প জুড়তো। তারপর কিছু একটা বাহানা বের করে মাকে বাজারে পাঠিয়ে দিত ঘন্টা খানেকের জন্য। মা হাসিমুখে চলেও যেত। পরে জেনেছিলাম, এর জন্য দাদাকে মায়ের হাতে বেশ কিছু করে টাকা দিতে হত। সেটা দিত দাদা বাড়িটা ফাঁকা পাওয়ার জন্য। আর একবার ফাঁকা পেলেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো আমার উপর। মুহুর্তের মধ্যে আমাকে খুবলে খুবলে খেতে শুরু করতো। প্রথম প্রথম দাদা আমাকে ছুঁলে শরীরে শিহরণ হত, কিন্তু কিছুদিন পর তা চলে গিয়েছিল। যাবে নাই বা কেন! দাদা তো আর আদর করতো না। ছিঁড়ে খেতো। আমি সব বুঝতে পারতাম। কিন্তু মুখে কিছু বলতাম না। বললেই আমার মনের মতো শরীর পাওয়া বন্ধ হয়ে যেত।

সে যাইহোক, দাদার সঙ্গে একপ্রকার অলিখিত চুক্তি হয়ে গিয়েছিল যেন। তাই ওই নিয়ে কিছু ভাবতাম না। কিন্তু কলেজে গেলেই আমাকে ক্লাসরুমে, ক্যান্টিনে নানারকম অত্যাচার সহ্য করতে হত। প্রায় প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ আমার স্তনে হাত দিতই। ভালো লাগতো না। একটুও। বাড়িতে পিসতুতো দাদা, কলেজে সহপাঠীরা, বাসের ভিড়ে সহযাত্রীরা প্রতিটা দিন আমার বুকে যে ব্যথা দিত তার খবর কেউ নিত না। সবার শুধু একটাই খরব, ওর স্তনগুলো অমন হচ্ছিল কি করে!

১২
এমনি করে কাটছিল দিন
হঠাৎ প্রেমে জীবন রঙীন

বেশ চলছিল। বুকে ব্যথা নিতে নিতে অভ্যাসও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অভাগার কপাল নিয়ে জন্মেছিলাম। সুখ তো ফুরুৎ হবেই। পিসতুতো দাদার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। ব্যাস, দাদা আসল নারী পেয়ে আমার মতো নকল নারীর কাছে আসা বন্ধ করে দিল। আমি চোখে সরষেফুল দেখতে শুরু করলাম। কি হবে এবার! ডাক্তারের কথা মতো আমার শরীর রেডি হয়ে গিয়েছে। এবার অপারেশান করিয়ে আমার বুকে সিলিকন বসিয়ে দেবে। ব্যাস, আমি হয়ে উঠব স্তনবতী। আর আমাকে দেখলে অর্ধনারী মনে হবে না। আমার শরীর পূর্নতা পাবে। কিন্তু টাকা! দাদার বাড়ি ছুটে গিয়ে দু’পায়ে আছড়ে পড়েছিলাম, দাদা এত কিছু করেছো। শেষটুকুও দাও। এর বিনিময়ে সারাজীবন তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকবো। দাদা সঙ্গে সঙ্গে এক লাথিতে পায়ের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমাদের বাড়ী এসে মাকে ডেকে বলে গিয়েছিল, মামি তোমরা তোমার ছোট ছেলেটাকে কিছু বলো না কেন? অমন হিজড়ে সেজে ঘুরে বেড়ায়… নাকি ও সত্যি সত্যিই তাই? আমাদের কাছে গোপন করে গিয়েছো!
এসব শুনতে শুনতে আমার কান মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠেছিল। মানুষ যে সত্যি সত্যি মুখোশধারী হয় সেই প্রথম দেখেছিলাম। মা দাদাকে সেদিন আমার সম্পর্কে কি বলেছিল জানি না। তবে বাড়ি যাওয়ার সময় দাদা শেষ বারের মতো আমার বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল দাদা যেন ওখানে একটা শুঁয়োপোকা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন সেই শুঁয়োপোকাটা আমার সারা শরীরে ঘুরে বেড়িয়েছিল। আমি হাজার চেষ্টা করেও তাকে মারতে পারিনি, নীরবে তার রোঁয়ার খোঁচা খেয়ে গিয়েছি।
তবে মারিনি বলেই বোধহয় আমার শরীর বেয়ে ঘুরে বেড়ানো সেই শুঁয়োপোকা থেকে একদিন হঠাৎ করেই জন্ম নিয়েছিল এক রঙীন প্রজাপতি। আর সেই প্রজাপতি উড়ে উড়ে গিয়ে আমার জন্য খুঁজে এনেছিল একটা মনের মানুষ।
কতদিন ভেবেছিলাম, চারদিকে এত মানুষ আছে, আমার জন্য কেউ নেই… ছিল। শুধু তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হয়তো ঠিকমতো খুঁজি নি বলে। নইলে যে কলেজ ছিল আমার সব থেকে বিরক্তির জায়গা সেই কলেজেই তাকে পেয়েছিলাম কি করে!

১৩
ছেলের গলায় গুনগুন গান
শুনেই জুড়ায় মন ও প্রাণ

বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই চাকরী পেয়ে গিয়েছিল। তাই ওকে নিয়ে আর কোন চিন্তা ছিল না। যত চিন্তা ছোটটাকে নিয়ে। একে তো ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো পোশাক পরা শুরু করেছিল। সেই নিয়ে বাড়িতে নিত্য অশান্তি লেগে থাকতো। ওর বাবা দু’চক্ষে এসব সহ্য করতো না। তাই ছেলেকে পইপই করে বারণ করতাম, ওই পোশাকে যেন বাবার যেন না যায়। সেই শুনে নাকি বাবার প্রতি অভিমানে ছেলে পারতপক্ষে বাবার সামনে যেতোই না। আর ওর বাবাও তেমনি একটা দিনের জন্যও ছেলের খোঁজ করতো না। একবাড়িতে থেকেও বাপ ছেলের মুখ দেখাদেখি ছিল না বলতে গেলে। আমিও অশান্তির ভয়ে এই নিয়ে কিচ্ছুটি বলতাম না।
ওর বাবাকেও কি দোষ দেব! পুরুষমানুষের রকমসকম বুঝি তো। একটুতেই রাগ। দয়ামায়া, স্নেহ, আদর এসব কখনো থাকতে দেখিনি পুরুষমানুষের মধ্যে। অবশ্য আমার চোখে দেখা কাছ থেকে দেখা পুরুষ বলতে তো দু’জন। এক আমার বাবা। কী রাশভারী লোক ছিলেন। ভয়ে কথায় বলতাম না। আর দ্বিতীয়জন আমার স্বামী। উনিও যেন শ্বশুরের ধাঁচে গড়া ছিলেন। ওনার দায়িত্ব নাকি শুধু টাকা রোজগার করা। ছেলেদের মানুষ করার দায়িত্ব মায়েদের। মা হিসেবে বড় ছেলের প্রতি সেই দায়িত্ব ঠিকঠাকই পালন করেছিলাম। কিন্তু ছোটটাকে তো… পারি নি।
যাক গে, যেকথা বলছিলাম। কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই ওর মধ্যে পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছিলাম। শালোয়ার কামিজ ছেড়ে আবার ছেলেদের মতো পোশাক পরা শুরু করেছিল। না, আগের মতো প্যান্ট শার্ট নয়। আবার ঠিক মেয়েদের পোশাকও নয়। দেখে ভালো লাগতো। মা হয়ে দেখতে লজ্জা করলেও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম ছেলে আর প্যাড দেওয়া ব্রা পরতো না। তার পরিবর্তে টাইট ফিটিং কী একটা পরতো। তার উপর পরে নিত পাঞ্জাবীর মতো এক ধরনের পোশাক। বাইরে থেকে বোঝাই যেত না যে ওর বুকে মেয়েদের মতো স্তন আছে। ছেলে এই যে নিজের মেয়েলি শরীরকে বাইরের লোকের কাছে লুকোতে শিখছিল এটা দেখেই ভালো লাগতো। তবে সেই ভালোলাগা ওর কাছে কোনদিনও প্রকাশ করি নি। ভয় হত। কিছু বললেই যদি আবার বেঁকে বসে।
আর একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম। ওর হাঁটাচলায় কথাবলায় কী সুন্দর সাবলীলতা এসেছিল। আর কথায় কথায় তর্ক করতো না। মুখের উপর না বলে ঘরের দরজা বন্ধ করতো না। রাত্রিরে না খেয়ে শুয়েও পড়তো না। তবে নিজেকে খুব বেশি মেলেও ধরতো না বাড়িতে। আসতো যেতো, খেতো ঘুমোতো। ওই কী যেন বলে পেয়িং গেস্টের মতো। আমিও কিছু বলতাম না। থাক নিজের মতো। ওরকম থাকলে যদি ভালো থাকে থাকুক। মা হয়ে সেটুকুই তো চেয়েছিলাম।
তবে উপরি পাওনা হিসাবে পেয়েছিলাম, ছেলের গলায় গুনগুন করে গান। ও ছোট থেকেই সাজতে ভালোবাসতো। ছবি আঁকা শিখতো। নাচ শেখার বায়না ধরেছিল কিছুদিন। শিখতে পাঠাইনি। ছেলে আমার এমনিতেই মেয়েলি ছিল। তার উপর নাচ শিখলে আর রক্ষে থাকতো না। কিন্তু গান কখনো ভালোবাসতো না। সেই ছেলে বড় হয়ে ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গায়। তার মানে বেশ আনন্দেই আছে। শুনে মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিত। ওই সময়টা খুব ইচ্ছে করতো ওকে কাছে টেনে নিতে। পারি নি! কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পর কাছে টেনে নিতে চাইলেই কি টেনে নেওয়া যায়? যায় না। তা সে যতই নিজের পেটের ছেলে হোক। তাই মা হয়ে ছেলের ভালোলাগা অদূরে দাঁড়িয়ে, আড়াল থেকে দেখতাম। আর মনে মনে ঠাকুরকে বলতাম ঈশ্বর ওর মঙ্গল কোরো।

১৪
নারীর মতো নারী তো নয়
বিয়ে সংসার কি করে হয়

সব কবি প্রেমিক কিনা জানি না। সব প্রেমিক কিন্তু কবি। প্রেমে পড়লেই ছন্দ করে কথা বলা প্রেমের ধর্ম। আমিও কবি হলাম। অবশ্য সত্যি কথা বলতে গেলে আমার প্রেমিক আমাকে কবি বানিয়েই ছেড়েছিল। উফ্‌। কী সব কবিতা লিখতাম।
বুকের ভিতর দু’টি হৃদয়
সদাই ধুকপুক।
একটি ঘরে বন্দী থাকে
আরেকটি খোঁজে সুখ।
আর আমার প্রেমিক সেই সব ছাঁইপাশ শুনে বাহ্ বাহ্ করে উঠতো। প্রেমে পড়ার প্রধান শর্ত বোধহয় প্রেমিকার সবকিছুকে ভালো বলা। আর যত্তরকম ছেলেমানুষী করা। আবোল তাবোল বকবক করা। যুক্তিহীন, বাস্তবতাহীন স্বপ্ন দেখা। কয়েকশো প্রতিজ্ঞা আর কয়েক হাজার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এবং আশ্চর্য সেগুলোকে সেই মুহুর্তে সব সত্যি বলে বিশ্বাস করা।
আমার প্রেমিকও তাই করত। ওর দেখাদেখি আমিও ওকে আমার মনের সবকিছু বলতাম। ও মন দিয়ে শুনতো। শুনতে শুনতে আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিত। মাঝে মাঝে চুপ করে শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাকিয়েই থাকতো। কি দেখতো কে জানে! কিন্তু আমি ওর চোখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়েই লজ্জাবতী লতার মতো মূর্ছা যেতাম। বলে উঠতাম, অমন করে রোজ কি দেখো বলো তো?
এমনি করেই বেশ কাটছিল। নিজেকে ওর পছন্দমতো সাজিয়ে তুলছিলাম। ঘাড় ঢাকা পড়ে যাওয়া আমার একমাথা চুল ও পছন্দ করতো না বলে কেটে ছোট করেছিলাম। শালোয়ার কামিজ ছেড়ে ইউনিসেক্সুয়াল ড্রেস পরা শুরু করেছিলাম। গাঢ় করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতাম না। চোখে আই লাইনার দেওয়া, কাজল দেওয়া, নখে নেলপালিশ দেওয়াও বন্ধ করেছিলাম। কপালের টিপ, কানের দুল, নাকের নাকছাবি সব খুলে তুলে রেখেছিলাম। ও আমাকে বোঝাতো, তুমি নারী কিনা তা পোশাক পরে বোঝাবে কেন? তোমার নারীত্ব তোমার ভিতরের সত্বা। তা বাইরের লোক বুঝলো কি বুঝলো না তাতে কি যায় আসে! তাছাড়া তোমার শরীর তুমি নও। তোমার কর্মই হল তুমি।
ওর কথা শুনে কেমন যেন বিশ্বাসও হত। সত্যিই তো আমি কি কেবল আমার শরীর! তার বাইরে আমার আমি বলে কিচ্ছু নেই! আছে অনেক কিছু আছে। আর তা আমি প্রমাণ করবই।
যাইহোক, শরীরের কথা উঠলেই আমার ভিতরে কেমন যেন হত। পিসতুতো দাদা চলে যাওয়ার পর এই শরীর আর কেউ ছোঁয় নি। কিন্তু যে একসময় দিনের পর দিন শরীরী ছোঁয়ায় বুঁদ হয়ে থেকেছে তার পক্ষে বেশিদিন উপোসী থাকা খুব কষ্টের। তবু ঠিক করেছিলাম, যত কষ্টই হোক নিজের যৌন ইচ্ছেগুলো লুকিয়ে রাখবোই। কিন্তু একটা সময়ের পর কোনকিছুই বোধহয় লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রেমের মতো সম্পর্কে। এই সম্পর্কের মাঝে এমন এক আয়না থাকে যাতে ভিতরের সব ছবি দেখা যায়। ও-ও দেখতে পেলো। আমার ঠোঁটে, আমার চোখের চাউনিতে…। তাছাড়া প্রেম তো বিরুৎ। একটু বেড়ে উঠলেই তাকে শরীরের অবলম্বন দিতে হয়। তখন সে শরীর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তরতর করে ওপরে ওঠে।

আমাদের প্রেমও একদিন শরীরের অবলম্বন খুঁজে নিয়েছিল। আর প্রেম একবার শরীর পেলে তা শরীরময় হয়ে ওঠে। চুম্বকে চুম্বকে খুব বেশি ঘষাঘষি করলে যেমন চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, শরীরে শরীর ঘষে তেমনই প্রেমে পড়ার আকর্ষণও নষ্ট হতে থাকে। তখন আকর্ষণ জিইয়ে রাখতে প্রেম করতে হয়। প্রেমে পড়া থেকে প্রেম করা।
কিছুদিন আমরাও প্রেম করেছিলাম। আর প্রেম করলে যা হয়, একসময় বিরক্তি আসে। আমাদের প্রেমেও তাই এসেছিল। সে আসুক। ক্ষতি ছিল না। জীবনে প্রেম আসা যেমন অনিবার্য তেমন প্রেমের বিচ্ছেদও ভবিতব্য। প্রেম তো এক ফাগুনের আয়ু নিয়ে আসে। তাই মেনে নিতে একটুও দ্বিধা করি নি। শুধু কষ্ট হয়েছিল প্রেমের বিচ্ছেদের কারণ হিসাবে ও যা বলেছিল সেটা শুনে।
ও আমার নারীত্বকে অস্বীকার করেছিল। একদিন পিসতুতো দাদা যেমন আমাকে ব্যঙ্গ করেছিল, ও-ও তেমনই বলেছিল। আমি নারীর মতো কিন্তু নারী নই। দিনের পর দিন যে লোকটা কাব্য করে বলতো,
মনের ভিতর তুমি নারী
বাকী সব তুচ্ছ।
প্রেমবারি বরষিলে নাচে
মনময়ূরীর পুচ্ছ।
সেই লোকটাই আমাকে শোনানো তার শেষ কবিতায় বলেছিল,
শরীরই সত্য, মন নয়
এ জীবন শুধু শরীরময়
তা শুনে ঠাস করে মারতে ইচ্ছে করেছিল। মারতে পারিনি। যাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম, ভালোবাসি তাকে কি মারা যায়! যায় না।

ওর বাড়ি থেকে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল। ও বলতেই পারতো, আমাকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তো আমার ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার গড়তে ওকে ভালোবাসিনি। তেমন কোন শর্ত কোনদিন উচ্চারণও করি নি। কি গো এত ভালোবাসছো? আমায় বিয়ে করবে তো? এমন কিছু যদি বলতাম, তাহলে ও না হয় অজুহাত খুঁজতো। আমি তো তা করি নি। আমি তো শুধু ভালোবেসেছিলাম। নিটোল নিখাদ ভালোবাসা। চলে যাওয়ার সময় ও যদি বলে যেত, তোমাকে বিয়ে করতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলাম তাহলে এ জীবন ধন্য হয়ে যেত। কিন্তু তা বলে নি। বলতে পারে নি। তবে আমি বিদায়বেলায় আমার শেষ কবিতা ওকে শুনিয়েছিলাম,
বলতে পারতে আয় দু’জনে শরীর জুড়াই
কেন দিয়েছিলে শুধু শুধু প্রেমের দোহাই!

১৫
নারীসাজ বন্ধ থাক
মনপাখি পুড়ে খাক

পিসতুতো দাদা টাকা দেওয়া বন্ধ করার পর হরমোনথেরাপি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল নারী হয়ে ওঠা। আর প্রেমে পড়ে প্রেমিককে খুশি করতে গিয়ে নিজের খুশি জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। খুলে রেখেছিলাম পছন্দমতো শরীরের সাজ। তখন তো ভাবি নি সেই প্রেমিক এভাবে আমার মনটাকে পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে যাবে। শরীর পুড়লে তার যন্ত্রণা হয়তো অনেক বেশি। তবে ডাক্তারি চিকিৎসায় সেই যন্ত্রণার উপশমও হয় দ্রুত। আর মন পুড়লে যন্ত্রণা হয় না, ব্যথা হয়। অথচ সেই ব্যথা কমাবার কোন ওষুধও নেই। সময় একমাত্র তার মলম। কিন্তু সময় যেন সেই সময় কাটতেই চাইতো না। দিনের পর দিন জানলার গরাদ ধরে শুধু আকাশ দেখে গিয়েছি। আর ভেবেছি আমার আকাশ বারবার কেন এমন মেঘে ঢাকা পড়ে যায়! শুধু ভাবতাম। আর বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতাম।
এভাবে বছর ঘুরে গেল। এই একটা বছরে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোই নি। মায়ের জোরাজুরিতে শুধু ক’বার ডাক্তারখানায় যেতে হয়েছিল। ডাক্তার আমাকে দেখে কি বুঝতেন কে জানে! তবে কিছু ওষুধ দিতেন যা আমার খুব উপকার করেছিল। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকতে পারতাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কত কি স্বপ্ন দেখতাম। মাথামুন্ডুহীন স্বপ্ন। একা একা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। হঠাৎ করে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠার স্বপ্ন। আবার মাঝে মাঝে ভয়ের স্বপ্নও দেখতাম। কে যেন আমার গলা টিপে ধরতো। দম নিতে পারতাম না। হাঁপিয়ে উঠতাম। দরদরিয়ে সারা শরীর ঘামে ভিজে যেত। মা কি করে বুঝতো কে জানে। ছুটে আসতো আমার ঘরে। মাথার বালিশটা সরিয়ে দিয়ে নিজের কোলটাকে বালিশ হিসেবে রাখত আমার মাথার নীচে। কিচ্ছুটি না বলে শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কিছুক্ষণ পর আমি শান্ত হয়ে যেতাম। তখন মাকে আমার ভিতরে জমে থাকা কষ্টের কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করতো। পারতাম না। গলার কাছে দলা পাকাতো। কিন্তু কিছুতেই উগড়ে দিতে পারতাম না। মাও জোর করতো না। পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত।
মায়ের এভাবে চলে যাওয়া দেখে আমার কান্না পেত। ছোটবেলায় মায়ের হাতে মার খেয়েও এমন কান্না পেত না। তখন মনে হত, মা তো আমাকে ভালোবাসে না। শুধু দাদাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই মা কোন্‌ মা। এভাবে আমি স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী আছি দেখেও কিছু বলে না। উল্টে ডাক্তার দেখায়, খাইয়ে দেয়, ঘুম ভেঙে গেলে ছুটে আসে! আমার এই মা’কে আমি ছোটবেলায় কেন পাই নি! পেলে হয়তো আমি নিজেকে নষ্ট করতাম না। নষ্ট হতাম না।
যাই হোক সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমি আবার একসময় চরা খুঁজে পেয়েছিলাম। দাঁড়িয়েছিলাম উঠে। পা রেখেছিলাম জীবনের নতুন রাস্তায়। এই নতুন করে চলার শুরুতে খুব ইচ্ছে করেছিল মাকে সবকিছু বলতে। কিন্তু বলতে পারতাম না। কেন পারতাম না? কোথায় বাধতো? তখন বুঝতে পারি নি। পরে বুঝেছিলাম বাধতো আমার পৌরুষে। যতই আমার স্বত্তা নারীর স্বত্ত্বা হোক না কেন পারিবারিক পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা নারীর মতো হয় নি। তাই আমার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা মা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল না। আর ছিল না বলেই মেয়েরা যেমন বড় হয়েও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতে পারে আমি পারি না। একটা লক্ষণরেখা থেকেই যায়। তাই মাকে এত কাছের করে পেয়েও আবার দূরে সরে যেতে হয়েছিল।
সেই দূরে সরে যাওয়া ক্রমেই বেড়েছিল। বাড়তে বাড়তে এত দূরের হয়ে গেল যে আর মায়ের কাছে ফেরা হল না।

 

চলবে…..

Loading

Leave A Comment